ঘুম! আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরম আপন একটি জিনিষ। কিন্তু কখনো কি ঘুম নিয়ে একটু ভেবে দেখেছেন। আপনি যদি আমার মতো ঘুম নিয়ে সৌখিন কেও হয়ে থাকেন তাইলে অবশ্যই ঘুম নিয়ে গভীর চিন্তা করে করে ক্লান্ত হয়ে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে পরেছেন। কিন্তু আপনারা যারা আমার মতো নন তাদের কি ঘুম নিয়ে কিছু তথ্য জানার প্রয়োজন নাই?
আপনারা যদি মনে করেন ঘুম তহ ঘুম, এ নিয়ে আবার কিসের চিন্তা, কিসের তথ্য? তাহলে আপনি অনেক ভুল চিন্তা করতেছেন। ঘুম মানুষের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। এবং ঘুম নিয়ে প্রচুর ভুল ধারনা আছে মানুষের মধ্যে। আমার আজকের এই আর্টিকেলে আমি সেইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
ঘুম কি?
উইকিপিডিয়ার ভাষ্য মতে
ঘুম বা নিদ্রা হচ্ছে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর দৈনন্দিন কর্মকান্ডের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যখন সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত থাকে। নিষ্ক্রিয় জাগ্রত অবস্থার সাথে ঘুমন্ত অবস্থার পার্থক্য হল এ সময় উত্তেজনায় সাড়া দেবার ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং শীতনিদ্রা বা কোমার চেয়ে সহজেই জাগ্রত অবস্থায় ফেরত আসা যায়। সকল স্তন্যপায়ী ও পাখি এবং বহু সরীসৃপ, উভচর এবং মাছের মধ্যে ঘুমানোর প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ী এবং অন্য বেশ কিছু প্রানীর (যেমন কিছু প্রজাতির মাছ, পাখি, পিঁপড়া এবং ফ্রুটফ্লাই) অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে নিয়মত ঘুম আবশ্যক। ঘুমানোর কারণ সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি জানতে পারেননি এবং তা নিয়ে বর্তমানে গবেষণা চলছে। আর একটি ব্যপার। ঘুমন্ত মানুষের চেহারার কোন এক অজানা অতিরিক্ত আবেগ অনুভূতি কাজ করে। যা তার গোপন এক প্রাকৃতিক নিরাপত্তা দেয়।
ঘুম এর এই সংজ্ঞা থেকেই বোঝা যায় ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
ঘুম নিয়ে আমাদের কিছু ভুল ধারনাঃ
- প্রতি রাতে এক ঘণ্টা করে কম ঘুমালে দিনের কাজে কোন সমস্যা হবে না : প্রতি রাতে এক ঘণ্টা করে কম ঘুমালে হয়তোবা আমাদের সারা দিন ই ঘুম ঘুম ধরবে না কিন্তু এভাবে অনেক দিন চলতে থাকলে আমাদের চিন্তা শক্তিতে আঘাত আসতে পারে।
- সারা সাপ্তাহ কম ঘুমিয়ে সাপ্তাহের শেষে এক সাথে বেশি ঘুমালেই চলবে : এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা, সারা সাপ্তাহ কম সময় ঘুমিয়ে সাপ্তাহের শেষে বেশি সময় ঘুমালে দেখা যায় আমাদের ঘুমের অনিয়ম আরও বৃদ্ধি পায় কারন একদিন বেশি দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে ওই দিন রাতে ঘুমাতে দেরি হবে। এভাবে স্লিপ ডেট বাড়তে থাকবে।
- দৈনিক ৬ ঘণ্টা ঘুম ই আমাদের জন্য যথেষ্ট : এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। একেকজন মানুষের ঘুমের প্রয়োজনীয়তা একেরকম। তাই সবার জন্য একই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা একটা ভুল ধারণা। যেকোনো মানুষের বয়স ভেদে ৭ থেকে ১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন হতে পারে ( এই বিষয়ে বিস্থারিত পরবরতিতে আছে )।
সঠিক পরিমাণ ঘুম না হলে কি সমস্যা?
পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া কে স্লিপ ডেট (Sleep debt) বা ঘুম ঋণ বলে। রেগুলার সঠিক পরিমাণ ঘুম না হলে আমাদের মাঝে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি দেখা দেয়। স্লিপ ডেট (Sleep debt) মূলত দুটি কারনে হতে পারে, একেবারেই ঘুম না হওয়ায় কিংবা অপূর্ণ ঘুম হওয়ায়। মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি ছাড়াও আরও অনেক সমস্যায় ভুগতে হতে পারে। নিচের ছবিটিতে কমন কিছু সমস্যার উল্লেখ আছে। শারীরিক সমস্যার মধ্যে ডায়াবেটিস ও স্থূলতা দুটি বড় সমস্যা। বর্তমান যুগে যখন আমরা সাফল্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমাদের ঘুম হ্রাস এর সাথে পৃথিবীতে এই দুটি সমস্যার বৃদ্ধি ও লক্ষণীয়। তা ছাড়া প্রতিনিয়ত মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ও কিন্তু কম ঘটছে না! আমাদের মানসিক ক্লান্তি কিন্তু আমাদের চারিপাশের মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্ক অবনতির একটি বড় কারন।
[https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Effects_of_sleep_deprivation.svg#References ]
কত সময় ঘুমানো উচিৎ ?
আমাদের সবার মাঝেই একটা ধারনা কাজ করে যে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য দৈনিক ৬ ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। কিন্তু এই ধারনাটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অ্যামেরিকার ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেসন এর ২০১৪ সালের একটি আর্টিকেল অনুযায়ী বয়স ভেদে ৭ থেকে ১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। নিচের টেবিলে তাদের বয়স ভেদে ঘুমের সময়ের প্রয়োজনীয়তার সুপারিশটি দেখানো হল।
বয়স | সুপারিশ (ঘন্টা) | হয়তো বা যথাযথ (ঘন্টা) | অনুচিত (ঘন্টা ) |
০-৩ মাস | ১৪ – ১৭ | ১১- ১৯ | ১১ থেকে কম বা ১৯ থেকে বেশি |
৪-১১ মাস | ১২- ১৫ | ১০ -১৮ | ১০ থেকে কম বা ১৮ থেকে বেশি |
১-২ বছর | ১১- ১৪ | ৯ – ১৬ | ৯ থেকে কম বা ১৬ থেকে বেশি |
৩-৫ বছর | ১০ -১৩ | ৮ – ১৪ | ৮ থেকে কম বা ১৪ থেকে বেশি |
৬-১৩ বছর | ৯ – ১১ | ৭ – ১২ | ৭থেকে কম বা ১২ থেকে বেশি |
১৪- ১৭ বছর | ৮ – ১০ | ৭ – ১১ | ৭ থেকে কম বা ১১ থেকে বেশি |
১৮-২৫ বছর | ৭ – ৯ | ৬ – ১১ | ৬ থেকে কম বা ১১ থেকে বেশি |
২৬- ৬৪ বছর | ৭ – ৯ | ৬- ১০ | ৬ থেকে কম বা ১০ থেকে বেশি |
> ৬৫ বছর | ৭ – ৮ | ৫ – ৯ | ৫ থেকে কম বা ৯ থেকে বেশি |
সোর্সঃ ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেসন
শুধু ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেসন নয় অন্যান্য সোর্স খুজলেও এই সুপারিশ এর কাছাকাছি সময়ের জন্য সুপারিশ পাওয়া যাবে। ছয় ঘণ্টার ঘুম যথেষ্ট ভাবার পিছনে যে মূল কারন হচ্ছে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে ( ৬৫ এর কম বয়সে ) ৬ ঘণ্টা ঘুম ই যথেষ্ট। এটি একটি জেনেটিক বিষয়, কিন্তু এই রকম মানুষের সংখ্যা কিন্তু অনেক কম (৩ % এর ও কম )। কিন্তু বাকি সবার জন্য কিন্তু ৬ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট নয়। প্রতিনিয়ত ৬ ঘণ্টা বা তার চেয়ে কম ঘুমালে স্লিপ ডেট (Sleep debt) এর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
একটা বিষয় কিন্তু লক্ষণীয় মানুষের বয়স যত বারে তার ঘুম কমতে থাকে। অত এব আপনার বাবা মার জন্য ৬ – ৭ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট বলে কিন্তু আপনার জন্য সেই পরিমাণ ঘুম যথেষ্ট না ও হতে পারে।
কখন ঘুম থেকে উঠবো ?
আমরা যখন ঘুমাই আমাদের ঘুমের তীব্রতা সাইকেল করে ( ঘুরতে থাকে, নিচের ছবিতে বিস্তারিত আছে)। আমাদের ঘুম মূলত দুই প্রকারের হয়ে থাকে REM sleep (Rapid Eye Movement Sleep) ও NREM sleep (Non Rapid Eye Movement Sleep)। REM sleep এর সময় আমরা সাধারণত স্বপ্ন দেখে থাকি আর তখন আমাদের চোখ নড়তে থাকে এবং এই সময় আমাদের ঘুমের তীব্রতা অনেক কম থাকে। NREM sleep এর সময় আমাদের ঘুমের তীব্রতা অনেক বেশি থাকে। আমাদের ঘুম যদি কখনো NREM sleep এর সময় ভাঙ্গে তখন আমাদের অস্বস্থি লাগে ও মাথা বেথা ও করতে পারে। কিন্তু REM sleep এর সময় ঘুম ভাঙলে কিন্তু এত খারাপ লাগে না।
NREM sleep কে আরও ৪ টি ভাগে ভাগ করা যায় এই চারটি স্টেজে আমাদের ঘুম ধীরে ধীরে বারে এবং সবচেয়ে গভীর ঘুমের (স্টেজ ৩ ও ৪) পরে REM sleep আসে যখন কিনা আমাদের ঘুম ধীরে ধীরে হাল্কা হতে থাকে। স্টেজ ১-৪ ও REM sleep শেষ করার পর কিছু সময়ের জন্য সজাগ হয়ে থাকি। এই সময়ে ঘুম ভাঙলে সবচেয়ে ভালো। এর পর আবার একই সাইকেল ঘুরতে থাকে। এই একটা সাইকেল সম্পন্ন করতে সাধারণত ৯০ মিনিটের মতো সময় লাগে।
অতএব ঘুমানোর পরে ৯০ মিনিটের গুণিতকের যেকোনো সময়ে ঘুম ভাঙলে আমাদের জন্য অনেক ভালো।
আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি কাউকে ঘুম থেকে ডাকতে হলে REM sleep এর সময় ডাক দিলে অনেক ভালো। কেউ REM sleep এ থাকলে আস্থে করে ডাক দিলে সাধারণত সে একটা ফিডব্যাক দেবে এবং তাঁকে ডাক দিলে সে হয়তো এত বেশি রাগান্বিত হবে ও না। বাচ্চাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্য এটা একটা ভালো কৌশল।
কিভাবে ভালো ঘুম ঘুমাব?
ঘুম ভালো হওয়ার জন্য নিচের উপদেশগুলো আপনাদের কাজে আসতে পারে
- সবসময় একই সময়ে শুতে যাওয়া ভালো।
- শুতে যাওয়ার আগে চা বা কফি না খাওয়া ভালো।
- শুতে যাওয়ার আগে মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন, ইলেক্ট্রনিক গেজেটের স্ক্রিন থেকে সাধারণত অতি বেগুনি রশ্মি বের হয় যা আমাদের ঘুমের জন্য ক্ষতিকর।
- ঘুমানোর আগে বই পড়তে পারেন, তবে ইলেক্ট্রনিক বই থেকে দূরে থাকুন।
- রুমের লাইট নিভিয়ে শুতে গেলে ঘুম তারা তারি ধরে। কিন্তু আপনি যদি লাইট ছাড়া একেবারেই ঘুমাতে না পারেন, লাল বা লালচে ধরনের ডিমলাইট ব্যবহার করতে পারেন।
- রুমের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখলে ঘুম ভালো হয়। ভালো ঘুমের জন্য ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ভালো তাপমাত্রা।
- খালি পেট থেকে হাল্কা ভরা পেটে ঘুম ভালো হয়।
আপনাদের আরও বিষদ জানার আগ্রহ থাকলে নিচের রিসোর্স গুলো ব্যবহার করতে পারেন।
- http://www.sleephealthjournal.org/article/S2352-7218(15)00015-7/fulltext
- http://www.journalsleep.org/CurrentIssue.aspx http://www.journalsleep.org/Search.aspx?SearchTerm=effect+of+sleep+deprivation
- https://sleep.org/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Sleep
- https://en.wikipedia.org/wiki/Sleep_debt
- https://en.wikipedia.org/wiki/Sleep_deprivation
P.S. I am not an expert on any of the topic in the article. I cannot stretch it too much. But I simply combined some published facts about sleep and my observation on the topic to help you know about the matter we are ignoring for a long time.